লকডাউন এবং বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতের কারণে এ বছরের প্রথম তিন মাসের তুলনায় এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে দেশের ব্যবসায় পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। মুনাফা, বিনিয়োগ, ব্যবসায় খরচ, বিক্রি বা রপ্তানি খাতে গত বছরের এপ্রিল-জুন সবচেয়ে খারাপ সময় পার করেছে। ঐ সময়ের তুলনায় এ বছরের এপ্রিল-জুন সময়টি খারাপ অবস্থানে রয়েছে।
করোনা সংকট কাটিয়ে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের জন্য সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের বাইরে রয়েছে ৭৯ শতাংশ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। করোনা মহামারিতে ব্যবসায় আস্থা সংক্রান্ত জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে।
কোভিড-১৯ মহামারির প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের আস্থা ও প্রত্যাশার ওপর সানেম ও দ্য এশিয়া ফাউন্ডেশনের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত জরিপের পঞ্চম পর্যায়ের ফলাফল গতকাল উপস্থাপন করা হয়। এ উপলক্ষ্যে আয়োজিত ভার্চুয়াল ওয়েবিনারে জরিপের ফলাফল উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এবং সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন দ্য এশিয়া ফাউন্ডেশনের বাংলাদেশ প্রতিনিধি কাজী ফয়সাল বিন সিরাজ।
পঞ্চম পর্যায়ে বাংলাদেশের আটটি বিভাগের ৩৭টি জেলার মোট ৫০১টি ক্ষুদ্র, ছোট, মাঝারি ও বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ওপর ফোনালাপের মাধ্যমে এই জরিপ করা হয়েছে। উত্পাদন খাতের তৈরি পোশাক, টেক্সটাইল, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, ফার্মাসিউটিক্যালস, হালকা প্রকৌশল ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের প্রতিষ্ঠানগুলো জরিপের অন্তর্ভুক্ত ছিল। সেবা খাতের পাইকারি ও খুচরা ব্যবসা, রেস্টুরেন্ট, পরিবহন, আইসিটি ও টেলিকমিউনিকেশন, আর্থিক খাত ও রিয়েল এস্টেট জরিপের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
জরিপের ফলাফল উপস্থাপনের সময় অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, জরিপে অংশগ্রহণকারী ৬৫ দশমিক ৭ শতাংশ প্রতিষ্ঠান আর্থিক ক্ষতি সামাল দেওয়ার জন্য ব্যক্তিগত সঞ্চয়ের ওপর নির্ভর করেছেন, ২৮ দশমিক ১ শতাংশ ধার নিয়েছেন, ১৯ শতাংশ কর্মী ছাঁটাই করেছেন, ৮ দশমিক ৮ শতাংশ কর্মীদের বেতন কমিয়ে দিয়েছেন ও ১৭ দশমিক ৮ শতাংশ প্রতিষ্ঠান প্রণোদনা প্যাকেজের আশ্রয় নিয়েছেন। বিশেষত ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত সঞ্চয়ের ওপর নির্ভরশীলতা একটি উদ্বেগজনক পরিস্থিতির ইঙ্গিত দেয়। আগামী দিনে কোনো সাহায্য না পেলে এই প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা যায়।
তিনি আরো উল্লেখ করেন, গত বছরের এপ্রিল-জুনের তুলনায় এ বছরের এপ্রিল-জুনে ব্যবসায় খরচ ছাড়া প্রায় সবগুলো খাতে অবস্থার উন্নতি হয়েছে। অন্য দিকে চলতি বছরের প্রথম তিন মাসের তুলনায় এপ্রিল-জুনে দেশের ব্যবসায় পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ফার্মাসিউটিক্যাল প্রতিষ্ঠানগুলো তুলনামূলকভাবে ভালো অবস্থানে থাকলেও লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, যানবাহন ও রিয়েল এস্টেট খাতগুলোর অবস্থা তুলনামূলকভাবে খারাপ।রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানগুলোর বর্তমান ব্যবসায় অবস্থা যেসব প্রতিষ্ঠান রপ্তানি করে না তাদের তুলনায় ভালো। ঢাকাভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলোও তুলনামূলক ভালো অবস্থানে রয়েছে।
তবে আশার বিষয় এই যে, চতুর্থ পর্যায়ে জরিপের অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ব্যবসায় আস্থা কম দেখা গেলেও পঞ্চম পর্যায়ের জরিপে কিছুটা উন্নতি হয়েছে। ২০২১ সালের এপ্রিল মাসে পরিচালিত চতুর্থ পর্যায়ের জরিপে এই সূচক ছিল ৪১ দশমিক ৩৯ এবং পঞ্চম পর্যায়ে এই সূচকের মান বেড়ে হয়েছে ৪৯ দশমিক ৭৪।
তবে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের দিক থেকে কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। ৪র্থ পর্যায়ের জরিপে ২ শতাংশ প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী পুনরুদ্ধারের কথা বললেও এপ্রিল-জুনে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ শতাংশে। মাঝারি পুনরুদ্ধারের ৩১ শতাংশ থেকে ২৭ শতাংশ এবং দুর্বল পুনরুদ্ধার ৬৭ শতাংশ থেকে কমে ৬৪ শতাংশে পৌঁছেছে। ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বৃহত্ শিল্প প্রতিষ্ঠানের তুলনা করতে গেলে দুর্বল ও মাঝারি পুনরুদ্ধার অনেকটা আগের মতো থাকলেও শক্তিশালী পুনরুদ্ধারের কথা মনে করছে কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান। এ ক্ষেত্রে রেমিট্যান্স, রপ্তানির সুযোগ, আর্থিক সাহায্য ও টিকাদান কর্মসূচি একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে বলে লক্ষ্য করা যায়।
জরিপে বলা হয়েছে, ২০২০ সালের মার্চ মাসের তুলনায় ২০২১-এর মার্চ মাসে প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসায় ৫৭ শতাংশ পুনরুদ্ধার হলেও জুন ২০২১ সালে পুনরুদ্ধারের মাত্রা কমে দাঁড়ায় ৩৫ শতাংশে। এক্ষেত্রে বৃহত্ প্রতিষ্ঠানগুলোই তুলনামূলক কম ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে।
চতুর্থ পর্যায়ের জরিপে যারা প্রণোদনা প্যাকেজ পাননি, তাদের মধ্যে ৬ শতাংশ প্রতিষ্ঠান পঞ্চম পর্যায়ের জরিপে জানিয়েছেন তারা প্রণোদনা প্যাকেজ পেয়েছেন। তবে এ ক্ষেত্রেও বৃহত্ প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রণোদনা পাওয়ার হার বেশি। নতুন ৬ শতাংশ প্রণোদনা পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ৪ শতাংশ ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠান ও ১৭ শতাংশ বৃহত্ প্রতিষ্ঠান গ্রহণ করেছে। জরিপকৃত মাঝারি কোনো প্রতিষ্ঠান নতুন করে কোনো প্রণোদনা প্যাকেজ গ্রহণ করেনি।