বরিশাল সদর উপজেলা কমপ্লেক্স থেকে ব্যানার অপসারণ করাকে কেন্দ্র করে ইউএনওর বাসভবনে হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনায় গতকাল বৃহস্পতিবার দুটি মামলা হয়েছে। দুই মামলাতেই সিটি মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহসহ কয়েকশ ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মো. শাহাবুদ্দিন খান মামলার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। এ ঘটনায় গতকাল দিনভর উত্তেজনা বিরাজ করে নগরীতে। ১৪ ঘন্টা বন্ধ থাকার পর দুপুর থেকে দূরপাল্লার বাস চলাচল শুরু হয়। বরিশাল জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তাদের ৬০ নেতাকর্মী গুলিবিদ্ধ হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে। ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্তেরও দাবি জানিয়েছে দলটি। পুলিশ ১৩ নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করেছে। অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে শহরে ১০ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে।
সে রাতে যা ঘটেছিল :বুধবার রাত ১০টার দিকে সিএন্ডবি রোডে সদর উপজেলা কমপ্লেক্সের ভিতরে ব্যানার অপসারণ করতে যায় বরিশাল সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এসময় রাতে অনুমতি ছাড়া ব্যানার অপসারণ নিয়ে সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মুনিবুর রহমানের সঙ্গে সিটি করপোরেশনের প্রশাসনিক কর্মকর্তা স্বপন কুমার দাসের কথা কাটাকাটি হয়। সেখানে উপস্থিত ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতা-কর্মীদের সঙ্গেও ইউএনওর উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়। এক পর্যায়ে আনসার সদস্যদের সঙ্গে নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ শুরু হয়। এক পর্যায়ে আনসার সদস্যরা গুলি ছুড়ে। এতে স্বপন কুমার দাসসহ চারজন আহত হন। এসময় যুবলীগ নেতা শাহরিয়ার বাবু, হারুন অর রশিদ ও তানভীরকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এছাড়া মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাসান মাহমুদ বাবু ইউএনওর বাসভবনে আটক থাকায় আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে সেখানে জড়ো হয়। এক পর্যায়ে সিটি করপোরেশনের মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ সেখানে উপস্থিত হলে তাকে লক্ষ্য করে আনসার সদস্যরা গুলি ছুঁড়লে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। এসময় পুলিশ ও আনসার সদস্যদের সঙ্গে বিক্ষুব্ধ নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষ বাধে। পুলিশের লাঠিচার্জে বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী আহত হলে শুরু হয় ইউএনওর বাসভবনে ইটপাটকেল নিক্ষেপ। প্রায় দু’ ঘন্টা ধরে এ অবস্থা চলে। এসময় আনসার ও পুলিশ সদস্যসহ প্রাথমিক ভাবে ৫০ জনেরও বেশি আহতের খবর পাওয়া গেছে। অনেকে গুলিবিদ্ধ হন। এক পর্যায়ে সিটি করপোরেশন কর্মীরা বর্জ্য মহাসড়কে ফেলে যানবাহন চলাচলের অনুপযোগী করে দেয়। পরে আইন-শৃংখলা বাহিনীর হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসলেও বুধবার রাত থেকে বৃহস্পতিবার দুপুর ১টা পর্যন্ত যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকে।
রাত সোয়া ২টার দিকে বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ বলেন, গুলি আমার গায়ে লেগেছিলো। ব্যথা পেয়েছি। তবে আমি গুলিবিদ্ধ হইনি। আমার গায়ে জ্যাকেট ছিলো। সেসময় নেতাকর্মীরা আমাকে সুরক্ষা দিতে গিয়ে অনেকেই গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। তাত্ক্ষণিক বিষয়টি প্রশাসনের উর্ধ্বতনদের ফোন করে অবহিত করেছি। এ বিষয়ে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
পুলিশ ও ইউএনওর পৃথক মামলা
এ ঘটনায় পুলিশের এক এসআই ও ইউএনও বাদী হয়ে পৃথক দুটি মামলা করেছেন। কোতয়ালী মডেল থানার ওসি নূরুল ইসলাম জানান, পুলিশের কাজে বাধা প্রদান ও হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি করার অপরাধে থানার এসআই শাহজালাল মল্লিক বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। এতে আসামি করা হয়েছে সিটি মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ, ২১নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর শেখ সাঈদ আহমেদ মান্না, বরিশাল জেলা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি সাজ্জাদ সেরনিয়াবাত, সাংগঠনিক সম্পাদক রাজিব হোসেন খান, মহানগর শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক পরিমল চন্দ্র দাস, মহানগর ছাত্রলীগ নেতা অনিক সেরনিয়াবাতসহ আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের ৯৪ জন নেতাকর্মীকে। এছাড়া আরো ৩/৪শত জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে। অন্যদিকে একই থানায় বরিশাল সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুনিবুর রহমানের দায়ের করা মামলায়ও প্রধান আসামি করা হয়েছে সিটি মেয়রকে। এছাড়া আরও ২৭ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত ৭০/৮০ জনকে আসামি করা হয়েছে। এই মামলায় ইউএনওর বাসভবনে অস্ত্র নিয়ে হামলার অভিযোগ আনা হয়েছে।
ইউএনও যা বললেন
বুধবার রাত পৌনে ২টার দিকে বরিশাল বিভাগীয় কমিশনার মো. সাইফুল হাসান বাদল, মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মো. শাহাবুদ্দিন খান, রেঞ্জ ডিআইজি এস.এম আক্তারুজ্জামান, র্যাব-৮ এর কোম্পানি কমান্ডার অতিরিক্ত ডিআইজি জামিল হাসান, বরিশাল জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দীন হায়দার ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসেন। তারা উপজেলা নির্বাহীর বাসভবন পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের এ ঘটনার সঠিক তদন্ত ও আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের কথা জানান।
এসময় সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বরিশাল সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মুনিবুর রহমান বলেন, বুধবার রাত ১০টার দিকে ১০/১৫টি মোটর সাইকেল করে জেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রাজিব আহমেদ উপজেলা কম্পাউন্ডে প্রবেশ করে ব্যানার ছিঁড়তে থাকে। এ বিষয়ে তাদের বারণ করা হলে তারা দুর্ব্যবহার করতে থাকে। এক পর্যায়ে তাকে ঘিরে ফেলা হলে আনসার সদস্যরা গুলি করে। এসময় মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদককে ইউএনও নিজেই আটক করেন বলে জানান। পরে কয়েকশ লোক তা বাসভবনে হামলা করলে তার কর্মকর্তারা বাসভবন তালা দিয়ে তাকে বাসার ভিতরে নিয়ে যান। তিনি বলেন, তার বৃদ্ধ বাবা-মা করোনায় আক্রান্ত হয়ে বাসভবনে চিকিত্সা নিচ্ছিলেন। এরমধ্যে এমন ঘটনায় তিনিসহ পুরো পরিবার আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন।
বিভাগীয় কমিশনার সাইফুল হাসান বাদল বলেন, তদন্ত করে দোষীদের আইনের আওতায় আনা হবে। বরিশাল জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দীন হায়দার বলেন, ব্যানার অপসারণ করতে হলে সেটা আমাদের আগে জানানো যেত। অনাকাঙ্ক্ষিত এ ঘটনা তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
প্রধানমন্ত্রীর কাছে রেজিগনেশন লেটার দেবো:সিটি মেয়র
বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ বলেছেন, ‘গুলি চালানোর ঘটনার জোড়ালো তদন্ত চাইবো। মেয়র হিসেবে এভাবে দায়িত্ব পালন করা সম্ভব না। প্রধানমন্ত্রী আমাকে শপথ পড়িয়েছেন, আমার বাবা আছেন তারা সিদ্ধান্ত নিবেন। যদি আমার অপরাধ হয়ে থাকে, আমি আমার রেজিগনেশন লেটার দিয়ে দেব।’ বুধবার দিবাগত রাত সোয়া ২টার দিকে নগরের কালিবাড়ি রোডস্থ সেরনিয়াবাত ভবনে ঘটনার বিবরণ শেষে গণমাধ্যমকর্মীদের তিনি এ কথা বলেন। এসময় মেয়র আরও বলেন, ‘আপনার (ইউএনও) সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয়ে থাকলে আমাকে বলতে পারতেন। বরিশালে এত বছরে এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি, যে এইভাবে আমাদের গুলি করা লাগবে। আবার শুনলাম যারা আহত হয়েছে তাদের গ্রেফতার করার জন্য মেডিকেলে গেছে। অপরাধ হয়ে থাকলে তাদের হয়নি, আমি মেয়র তাই মাথা পেতে নিলাম, আমি রেজিগনেশন লেটার প্রধানমন্ত্রীর কাছে দিয়ে দেবো।’
বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবী আওয়ামী লীগের
বিকাল ৪টার দিকে নগরীর কালিবাড়ি রোডস্থ সিটি মেয়রের বাসভবনে সংবাদ সম্মেলন করে বরিশাল জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র গাজী নঈমুল ইসলাম লিটু। এসময় তারা বলেন, ব্যানার অপসারণের কাজ শুরু করলে ইউএনও তার বাসভবন থেকে বের হয়ে পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের বাধা দেন। তিনি তাদেরকে বলেন আমার কম্পাউন্ডে কোন মেয়র গিরি চলবে না, তোমরা চলে যাও। এসময় সেখানে উপস্থিত বিসিসির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আনসার সদস্যদের গুলি করার নির্দেশ দেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলে তাকে লক্ষ্য করেও গুলি ছোড়া হয় বলে অভিযোগ করেন তারা। সংবাদ সন্মেলনে দাবি করা হয়, এপর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুসারে তাদের ৬০ জন নেতাকর্মী গুলিবিদ্ধ হয়েছেন।
সংবাদ সম্মেলনে বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট তালুকদার মো. ইউনুস বলেন, একটি শান্ত শহরকে অশান্ত করতে এমন ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটানো হয়েছে। ইউএনওর বাসায় কেউ হামলা করেনি। এটি একটি পরিকল্পিত ঘটনা। এর বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করছি। বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এ্যডভোকেট জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, সিটি মেয়রকে বির্তকিত করতে এমন ঘটনা ঘটিয়েছে তারা। তিনি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহার, গ্রেপ্তারকৃত নেতাকর্মীদের মুক্তি ও আহত নেতাকর্মীদের দ্রুত চিকিত্সার ব্যবস্থা করার দাবি জানান।
গ্রেফতার ১৩
ইউএনওর বাসভনে হামলার ঘটনায় বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত পুলিশ আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের ১৩ নেতাকর্মীকে আটক করেছে। কোতোয়ালী মডেল থানার দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানান, আটককৃতদের মধ্যে রয়েছেন মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাসান মাহমুদ বাবু, ত্রাণ বিষয়ক সম্পাদক মোয়াজ্জেম হোসেন ফিরোজ, ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি অলিউল্লাহ অলি প্রমুখ
১৪ ঘন্টা পর বাস চলাচল শুরু
১৪ ঘণ্টা বন্ধ থাকার পর বরিশাল থেকে দূরপাল্লাসহ সব রুটে বাস চলাচল শুরু হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুর ১টা থেকে বাস চলাচল শুরু হয়। এর আগে বুধবার দিবাগত রাত ১১টার দিকে বরিশাল থেকে দূরপাল্লার বাস চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পাশাপাশি বৃহস্পতিবার সকাল থেকে লঞ্চ চলাচলও বন্ধ হয়ে যায়। আকস্মিক যানবাহন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চরম দুর্ভোগে পড়েন যাত্রীরা।
১০ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন
নগরীতে যেকোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে ১০ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন রাখা হয়েছে। একইসঙ্গে মাঠে থাকছে অতিরিক্ত ১০ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বরিশাল বিভাগীয় কমিশনার মো. সাইফুল হাসান বাদল এ তথ্য জানান। এর আগে দুপুরে বরিশাল জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দীন হায়দার ১০ প্লাটুন বিজিবি ও ১০ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট চেয়ে তার কাছে আবেদন করেন। তার প্রেক্ষিতে বিকেলে খুলনা জোন থেকে ১০ প্লাটুন বিজিবি বরিশালে এসে পৌঁছায়।
মেয়রের বাসভবন ঘিরে রাখে র্যাব-পুলিশ