কোভিডের আগেই গত বছরের শেষার্ধে বিশ্ব অর্থনীতি নিয়ে ছিল নানা শঙ্কা। চীন-মার্কিন বাণিজ্য যুদ্ধের প্রভাব এবং বিশ্ব জুড়ে মন্দার পদধ্বনি আগেই আঁচ করা গিয়েছিল। তার পরই করোনার প্রভাব এবং মহামন্দায় ঢুকে যাওয়া অর্থনীতিতে সৃষ্ট অস্থিরতা দীর্ঘমেয়াদি রূপ নিতে যাচ্ছে। এরই মধ্যে বিপর্যস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারেরও কোনো সুস্পষ্ট লক্ষণ নেই বরং স্থবির হয়ে পড়া ব্যবসা-বাণিজ্য পরিস্থিতিতে আগামী দিনগুলো আরো অনিশ্চয়তায় কাটবে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশ্লেষকরা বলেছেন, ২০২৩ সালের আগে পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ায় গতি আসবে না। এরই মধ্যে ছাঁটাই হওয়া কর্মীদের সবাই কাজের সুযোগও পাবেন না। উন্নত দেশগুলোতে সামাজিক নিরাপত্তা সুবিধার আওতায় থাকলেও নিম্নআয়ের দেশগুলোর বেকাররা দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাবে। এককথায় করোনা ভাইরাস অর্থনীতিতে কতটা ক্ষতি করতে পারে সেটি অননুমেয়। কারণ, বাংলাদেশি পণ্য আমদানিকারক দেশগুলো তাদের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়াসহ পুনরুদ্ধারে নানা প্রণোদনা ঘোষণা করেছে। তথাপি মন্দার কবল থেকে পরিত্রাণ মিলছে না তাদেরও। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের করণীয় নিয়েও কথা বলছেন কেউ কেউ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে আমাদের কিছুটা কৌশলী হতে হবে। এখন অপ্রয়োজনীয়, বিলাসী ও ভোগ্যপণ্য আমদানি কমাতে হবে। অন্যদিকে রপ্তানি বাড়ানোর জন্য চেষ্টা করতে হবে। এজন্য বিকল্প কোনো ব্যবস্থা আছে কি না সেটাও খুঁজে বের করতে হবে।
এমনিতেই গত কয়েক বছর ধরে নানা কারণে দেশে শিল্পোদ্যোগের বড় অংশই শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখছে না। গ্যাস-বিদ্যুত্ সংকট তো রয়েছেই। টিকতে না পেরে একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে কারখানা। সাম্প্রতিক করোনা ভাইরাসের বৈশ্বিক মহামারি এই পরিস্থিতিকে আরো জটিল করেছে। কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনের (ডিআইএফই) হিসাব অনুযায়ী, করোনা পরিস্থিতি শুরু হওয়ার পর ১৫ হাজার ৯৬৫টি কারখানা বন্ধ হয়েছে। এর মধ্যে গার্মেন্টস কারখানা ১ হাজার ৯১৫টি এবং গার্মেন্টসের বাইরে অন্যান্য খাতের কারখানা ১৪ হাজার ৫০টি।
এসব কারখানায় কাজ করতেন ১০ লাখ ৫১ হাজার শ্রমিক। এসব শ্রমিকের বেশির ভাগই বর্তমানে বেকার। বন্ধ হওয়া প্রায় ২ হাজার গার্মেন্টস কারখানার মধ্যে বেশির ভাগই রপ্তানিমুখী। তবে এ তালিকায় তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর সদস্যভুক্ত পোশাক মালিকের বাইরেও বিপুলসংখ্যক কারখানা রয়েছে।
সূত্র জানায়, বন্ধ হওয়া এসব কারখানা মূলত স্বল্প পুঁজির এবং অপেক্ষাকৃত ছোট আকৃতির। রপ্তানি আদেশ বাতিল কিংবা স্থগিত হওয়ায় এবং সময়মতো তৈরি পণ্যের অর্থ না পাওয়ায় অনেক কারখানা বন্ধ হয়েছে। গত ফেব্রুয়ারি থেকেই বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাসের প্রকোপ শুরু হলেও বাংলাদেশে এর প্রকোপ শুরু হয় মার্চ থেকে। ক্রমেই সংক্রমণ বাড়তে থাকায় সরকার মার্চের শেষের দিকে এসে লকডাউনের আদলে দেশব্যাপী ছুটি ঘোষণা করে। দুই থেকে আড়াই মাস শেষে অর্থনীতি ধীরে ধীরে চালু করা হলেও গতি আসেনি। বিশ্ববাজারে চাহিদা কমে যাওয়ায় রপ্তানিও কমে গেছে ব্যাপক হারে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হিসাব অনুযায়ী, সদ্যসমাপ্ত (২০১৯-২০) অর্থবছরে রপ্তানি কমেছে প্রায় ৫৮ হাজার কোটি টাকার। এর প্রভাবে ব্যাপক হারে কর্মহীন হচ্ছেন কর্মী। প্রাতিষ্ঠানিক খাতের বাইরেও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে বিপুলসংখ্যক মানুষ কর্মহীন হচ্ছেন।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা পরিষদের (বিআইডিএস) হিসাবে করোনা পরিস্থিতিতে ১ কোটি ৬০ লাখ মানুষ কর্মহীন হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন। করোনা ভাইরাসে সৃষ্ট সংকট থেকে ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বৃহত্ শিল্প রক্ষা করতে বিভিন্ন খাতে সরকার প্রায় ১ লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। শুধু তৈরি পোশাক খাত তথা রফতানি খাতে কিছু প্রণোদনা দিলেও অন্যান্য খাতে এখনো প্রণোদনার অর্থ মেলেনি, বরং ব্যাংক কর্মকর্তা কর্তৃক উদ্যোক্তাদের নিরুত্সাহিত করার অভিযোগ রয়েছে। প্রণোদনার অর্থ না পেয়ে বিপাকে পড়েছেন উদ্যোক্তারা। কলকারখানার মালিক, ব্যবসায়ীরা তাদের কর্মীদের চাপে রয়েছেন।
গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই)-এর নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, বিশ্ব অর্থনীতির মন্দার বিভিন্ন প্রভাব ইতিমধ্যে দেশের অর্থনীতিতে পড়তে শুরু করেছে। ভবিষ্যতে এটা আরো বাড়তে পারে বলেও আশঙ্কা করেন তিনি।
এ অবস্থায় নতুন কর্মকৌশল প্রণয়ন জরুরি বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। অর্থনীতিবিদ ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী বলেন, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অর্জন ধরে রাখতে হবে। রাজস্ব ও মুদ্রানীতির সমন্বয় ঘটিয়ে নীতিসহায়তা প্রদান করতে হবে। এ পরিস্থিতিতে উদ্যোক্তা থেকে শুরু করে শ্রমিক পর্যন্ত সবাইকে বাঁচিয়ে রাখার উদ্যোগ নিতে হবে।